টানা সাড়ে চার মাস ধরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরায়েল। এতে করে অবরুদ্ধ ওই ভূখণ্ডটিতে তীব্র মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে অস্থায়ী তাঁবুসহ আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন।

তাদের জন্য জীবন রক্ষাকারী খাদ্য সরবরাহ করা জরুরি হলেও তা বন্ধ করে দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। মূলত ভূখণ্ডটিতে ব্যাপক বিশঙ্খলার কারণে এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে সংস্থাটি।

বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার উত্তরাঞ্চলে ‘লাইভ-সেভিং’ খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। জাতিসংঘের এই সংস্থাটি বলেছে, ব্যাপক বিশৃঙ্খলার কারণে তাদের সহায়তা কনভয়গুলো সম্পূর্ণরূপে বিপর্যয় এবং সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছে।

সংস্থাটি আরও বলেছে, এই সিদ্ধান্তটি সহজভাবে নেওয়া হয়নি। তাদের সদস্যরা ব্যাপক ভিড়, বন্দুকযুদ্ধ এবং লুটপাটের সম্মুখীনও হয়েছেন।

এছাড়া জাতিসংঘ গত বছরের ডিসেম্বর থেকে গাজার উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বলে আসছে। ডব্লিউএফপি বলেছে, সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলোতে এই ভূখণ্ডে ‘ক্ষুধা ও রোগের দ্রুত ছড়িয়ে’ পড়ার প্রমাণ রয়েছে।

বিবিসি বলছে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গত বছরের অক্টোবরে স্থল আক্রমণের শুরুতে ১১ লাখ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে উত্তরাঞ্চলীয় ওয়াদি গাজার সমস্ত এলাকা থেকে সরে গিয়ে দক্ষিণে আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ দেয়। যেসব এলাকা থেকে সেসময় সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে গাজা শহরও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই শহরটি ছিল যুদ্ধের আগে এই অঞ্চলের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।

বেশিরভাগ বাসিন্দাই সেসময় ইসরায়েলি আদেশ অনুসরণ করে, কিন্তু কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি এই এলাকাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, যাদের অনেকেই আবার পালিয়ে যেতে সক্ষম ছিল না। পরে ইসরায়েলি সৈন্যরা এই অঞ্চলটিকে ঘেরাও করে এবং সেখানে হামাসের শক্ত ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।

গত মাসে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানায়, অন্তত ৩ লাখ মানুষ এখনও উত্তর গাজায় রয়েছেন যারা বেঁচে থাকার জন্য তাদের সহায়তার ওপর নির্ভর করছেন।

মূলত তীব্র সংঘাতের কারণে গাজার উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ হয়ে থাকে খুবই কম। এছাড়াও অল্প পরিমাণে যে সহায়তা বিতরণ হয় সেটিও আবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা ছাড়পত্রের ওপর নির্ভরশীল।

এই সপ্তাহান্তে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গাজার এই অঞ্চলে সপ্তাহব্যাপী সহায়তা সরবরাহের আশা করেছিল। প্রতিদিন এখানে সহায়তা-ভর্তি ১০টি লরিও পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল তারা। কিন্তু রোববার সংস্থাটির একটি কনভয়কে উত্তরের ওয়াদি গাজা চেকপয়েন্টের কাছে ‘ক্ষুধার্ত বিপুল সংখ্যক মানুষ’ ঘিরে ধরে এবং লোকেরা গাড়িতে আরোহণের একাধিক প্রচেষ্টা চালায়। এরপর গাজা শহরে প্রবেশ করার সময়ও গোলাগুলির মুখোমুখি হয় কনভয়।

এছাড়াও, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিস এবং দেইর আল-বালাহ শহরের মধ্যবর্তী স্থানে বেশ কয়েকটি সহায়তাবাহী লরি লুট করা হয়েছে এবং একজন চালককে মারধর করা হয়েছে। ডব্লিউএফপি বলেছে, গত দুই দিনে তাদের দল গাজা উপত্যকায় ‘অভূতপূর্ব মাত্রার হতাশার সাক্ষী হয়েছে’।

সংস্থাটি বলছে, ‘খাদ্য এবং নিরাপদ পানি অবিশ্বাস্যভাবে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে এবং সেখানে বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। নারী ও শিশুদের পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং এর ফলে অঞ্চলটিতে তীব্র অপুষ্টি বেড়েছে। মানুষ ইতোমধ্যেই ক্ষুধাজনিত কারণে মারা যাচ্ছে।’

আরো পড়ুনঃ গাজায় যুদ্ধ নয় গণহত্যা চলছে, বললেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট

গত সোমবার ডব্লিউএফপি এবং জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের একটি যৌথ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গাজার উত্তরে পরিস্থিতি ‘বিশেষ করে খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে’। ডব্লিউএফপি বলছে, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে, দুই বছরের কম বয়সী ১৫ শতাংশেরও বেশি শিশু তীব্রভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে।

সংস্থাটি বলেছে, তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘দায়িত্বপূর্ণ পদ্ধতিতে’ সহায়তা বিতরণ পুনরায় শুরু করার উপায় খুঁজে বের করবে এবং একইসঙ্গে উত্তর গাজায় সাহায্য বিতরণ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের আহ্বানও জানিয়েছে তারা। আর এর জন্য একাধিক রুট থেকে গাজায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি পরিমাণে খাবার প্রবেশ করানো প্রয়োজন এবং ইসরায়েল ও উত্তর গাজার মধ্যে ক্রসিং পয়েন্টগুলো খোলার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

জাতিসংঘের এই সংস্থাটি গাজায় একটি কার্যকরী মানবিক ব্যবস্থা, স্থিতিশীল যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং সংস্থার কর্মী ও অংশীদারদের পাশাপাশি গাজাবাসীদের জন্য নিরাপত্তারও আহ্বান জানিয়েছে।

Social Share This Story, Choose Your Platform!